জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি

অস্থায়ী পদ্ধতি

ক্যালেন্ডার পদ্ধতি

মেয়েদের ঋতুচক্রের (Menstrual cycle) এমন কিছু দিন আছে যা সাধারনত নিরাপদ দিবস (Safe period) হিসেবে ধরা যায়। এই দিন গুলোতে স্বামী-স্ত্রীর অবাধ মিলনের ফলেও স্ত্রীর গর্ভবতী হবার সম্ভাবনা থাকে না। যেহেতু এই পদ্ধতিটি প্রাকৃতিক ভাবেই নির্দিষ্ট করা তাই একে প্রাকৃতিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি কিংবা ক্যালেন্ডার পদ্ধতি বলা হয়ে থাকে।

এ পদ্ধতি কার্যকর করার জন্য অবশ্যই জেনে নিতে হবে আপনার ঋতুচক্রের কোন দিন গুলো নিরাপদ। এজন্য সবার আগে জানতে হবে আপনার মাসিক নিয়মিত কিনা, নিয়মিত না হলে তা কতদিন পরপর হয়। এবার সবচেয়ে কম যতদিন পর মাসিক হয়ে থাকে তা থেকে ১৮ দিন বাদ দিন, মাসিক শুরুর ১ম দিন থেকে ঐ দিনটিই হলো প্রথম অনিরাপদ দিন। আবার সবচেয়ে বেশী যতদিন পর আপনার মাসিক হয় তা থেকে ১০ দিন বাদ দিন, মাসিক শুরুর দিন থেকে ঐ দিনটিই হলো শেষ অনিরাপদ দিন

ধরুন আপনার মাসিক ৩০ থেকে ৩৫ দিন পরপর হয়। তাহলে ৩০-১৮=১২, অর্থাৎ মাসিকের শুরুর পর থেকে প্রথম ১১ দিন আপনার জন্য নিরাপদ দিবস, এই দিন গুলোতে কোনো পদ্ধতি গ্রহন ছাড়াই সঙ্গম করা যাবে। ১২তম দিন থেকে অনিরাপদ দিবস, তাই ১১তম দিন থেকে মেলামেশায় সংযম আনতে হবে। আবার যেহেতু ৩৫ দিন হলো আপনার দীর্ঘতম মাসিক চক্র তাই ৩৫-১০=২৫,অর্থাৎ ২৫তম দিন আপনার জন্য শেষ অনিরাপদ দিবস। ২৬তম দিবস থেকে আপনি আবার অবাধ সঙ্গম করতে পারবেন। অর্থাৎ এখানে শুধু ১২ম থেকে ২৫তম দিবস পর্যন্ত আপনি অবাধ সঙ্গম করলে আপনার গর্ভধারন করার প্রবল সম্ভাবনা আছে। তবে আপনারা সহজেই কনডম (Condom) ব্যবহার করে ঝুকিমুক্ত থাকতে পারবেন।

তবে জেনে রাখা ভালো অনিয়মিত মাসিক হবার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি কার্যকর হবে না  যদি আপনার হিসাব রাখতে সমস্যা হয় তবে বলা যায় মাসিক শুরুর পর প্রথম ৭ দিন এবং মাসিক শুরুর পূর্ববর্তী ৭ দিন অবাধ সঙ্গম করা নিরাপদ।

জেনে রাখা ভাল প্রাকৃতিক জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি ৮০% নিরাপদ। সাধারনত হিসেবে গোলমাল করলে, অনিরাপদ দিবসেও ঝুকি নিলে কিংবা অনিয়মিত মাসিক হলে এই পদ্ধতি ব্যর্থ হতে পারে। তাই সঠিক হিসেব জানতে প্রথম বার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্মরনাপন্ন হওয়া সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। কিছু পুরুষের শুক্রানু বেশী দিন বেঁচে থাকার কারনে তারা এটায় সফল নাও হতে পারেন এবং সেক্ষেত্রে অনিরাপদ দিনগুলো ২ দিন পর্যন্ত বাড়াতে হতে পারে। অনেকে এই পদ্ধতি ঝামেলাপুর্ণ মনে করেন কিন্ত এতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে এটা বেশ সহজ এবং কোন রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন।

 

কনডম পদ্ধতি

কনডম হলো জনপ্রিয় জন্মবিরতি করন পদ্ধতি। এর কারন যেকোনো সময় কনডম ব্যবহার করা যায় এবং এটা অনেক সহজলভ্য। কনডম ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এটা যৌনবাহিত যেকোনো রোগ থেকে নারী-পুরুষ দুজনকেই নিরাপত্তা প্রদান করে। এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া, ক্লামাইডিয়া কিংবা কন্ডাইলোমা সহ যে কোন ধরনের যৌন রোগ কনডম ব্যবহারের মাধ্যমে এড়ানো সম্ভব।

অনেক পুরুষ আছেন যাদের মিলনের আগেই বীর্যপাত হয়ে যায় (Premature ejaculation) তারাও অনেক সময় কনডম ব্যবহারে অনেকটা সুবিধা পেতে পারেন, এছাড়া কিছু মহিলার স্বামীর শুক্রানুতে তাদের এলার্জি থাকে, মাত্র ৬ মাস কনডম ব্যবহার করে এই এলার্জি নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব, লিঙ্গ প্রবেশের প্রথম দিকে খসখসে ভাব কিংবা ব্যথা হলেও কনডম ব্যবহারে উপকার পাওয়া যায়।

কনডম ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই মেয়াদ উত্তীর্নের তারিখ দেখে নিতে হবে। কনডম খোলার পর যেন ভিতরের বাতাস না থাকে সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে অন্যথায় তা সহজেই ফেটে গিয়ে শুক্রানু যোনিপথে প্রবেশ করতে পারে। দৈহিক মিলন শেষে উত্থিত থাকা অবস্থায় লিঙ্গ বের করে নিয়ে আসতে হবে, তা না হলে শুক্রানু ছড়িয়ে যেতে পারে।

কনডম ব্যবহার জন্মনিয়ন্ত্রনের শতকরা ১০০ ভাগ নিরাপত্তা প্রদান করে না। এর সাফল্যের হার শতকরা ৯০ ভাগের কাছাকাছি। সঠিক নিয়ম মাফিক ব্যবহার না করাতেই ব্যর্থতা দেখা দেয়, তাই অবশ্যই ব্যবহারের পূর্বে কনডম এর ভিতরের বাতাস বের করে নিতে হবে।

অনেক সময় কোন দম্পত্তির কনডমে এলার্জি থাকতে পারে তাদের ক্ষেত্রে কনডম ব্যবহার না করাই শ্রেয়। দীর্ঘদিন কনডম ব্যবহারের ফলে অনেক সময় দম্পতিরা এক ধরনের মানসিক অতৃপ্তি কিংবা অশান্তিতে ভুগতে পারেন। কনডম ব্যবহারের সাথে সাথে প্রাকৃতিক ভাবে জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি ব্যবহার করে স্বামী-স্ত্রী আরামদায়ক এবং সুখী যৌন জীবন উপভোগ করতে পারেন।

 

কপার টি

অনেক দম্পত্তির কাছেই প্রতিদিন পিল খাওয়া কিংবা কনডম ব্যবহার করা একটা বিরক্তিকর কাজ বলে মনে হয়। আই.ইউ.সি.ডি (কপার টি) মূলত তাদের জন্যই ঝামেলাহীন কার্যকরী কম খরচের একটি অস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি। একবার কপার টি ব্যবহার করলে অন্তত ১ বছর থেকে আনুমানিক ৮ বছর পর্যন্ত অন্য কোনো পদ্ধতি ব্যবহার না করেও জন্মনিয়ন্ত্রন করা সম্ভব।

আই.ইউ.সি.ডি Device দেখতে অনেকটা ইংরেজি অক্ষর T এর মতো দেখতে তাই একে কপার টি বলা হয়। কপার টি মহিলাদের জরায়ুতে যোনিপথের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করানো হয়। বর্তমানে তিন ধরনের আই.ইউ.সি.ডি পাওয়া যায়, লিপিস লুপ-কপার টি এবং হরমোন নিসৃত করা আই.ইউ.সি.ডি। এর মধ্যে হরমোন নিসৃতকারি কপার টি মাত্র ১ বছর কার্যকর থাকে, অন্য গুলো প্রায় ৭ থেকে ৮ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকে।

আই.ইউ.সি.ডি ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হয়, স্বামী-স্ত্রী দুজনে রাজি থাকলেই কেবল এটা ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়ে থাকে। মাসিক শেষ হবার পরই এই পদ্ধতি গ্রহনের উপযুক্ত সময়, এছাড়া সন্তান জন্মানোর পরও এটা পরানো যায়। কোনো মহিলার জরায়ুতে কিংবা ডিম্বাশয়ে কোন ইনফেকশন থাকলে কোনো অবস্থাতেই আই.ইউ.সি.ডি পরানো যাবে না।

আই.ইউ.সি.ডি বা কপার টি ব্যবহারের পর অনেক ক্ষেত্রে মাসিক এর সময় অধিক রক্তপাত এবং তলপেটে ব্যথা হতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে আবার আই.ইউ.সি.ডি নিজ থেকেই বের হয়ে আসতে পারে। এছাড়া একটোপিক জাতীয় প্রেগনেন্সি সমস্যাও আই.ইউ.সি.ডি ব্যবহারে বেশী করা হয়়।

কপার টি পদ্ধতি ব্যবহার করা অবস্থায়ও সন্তান নেবার ইচ্ছা হলে এটি বের করে নেয়া যায় এবং নির্দিষ্ট সময়ের পর সন্তান নেয়া যায়। জন্মনিয়ন্ত্রনে আই.ইউ.সি.ডি এর সাফল্যের হার তুলনামুলকভাবে অনেক বেশী এবং তা প্রায় ৯৭%, যতটুকু ব্যর্থতা তা শুধুমাত্র আই.ইউ.সি.ডি নিজে থেকেই বেরিয়ে আসার কারনে হয়, তাই এ ব্যপারে সাবধান অবলম্বন হবে। কম সচেতন দম্পত্তির জন্য এটা খুবই কার্যকর জন্মবিরতীকরন পদ্ধতি। যাদের পিল খাওয়ায় বিভিন্ন সমস্যা হয় এবং অন্য সকল পদ্ধতি আরামদায়ক মনে হয়না তারা খুব সহজেই কপার টি ব্যবহারের কথা ভেবে দেখতে পারে।

স্থায়ী পদ্ধতি

 ভ্যাসেকটমি

ভ্যাসেকটমি হচ্ছে পুরুষদের স্থায়ী জন্ম নিয়ন্ত্রনের একটি পদ্ধতি। অন্ডকোষে পুরুষদের যে ২টি শুক্রাশয় (Testes) থাকে তা থেকে ভাস (Vas difference) নামক দুটি আলাদা নালী দিয়ে শুক্রানু  পুরুষাঙ্গের মাথায় পৌছায়। ভ্যাসেকটমি অপারশনের মাধ্যমে পুরুষের অন্ডকোষের নীচের দিকে খুবই ছোট একটি অংশের চামড়া কেটে ঐ ভাস দুটিকে কেটে ফেলা হয়।

এর ফলে মিলনে বীর্যপাতের সময় বীর্য রস (Semen) আসলেও তাতে কোনো ধরনের শুক্রানূর (Sperm) উপস্হিতি থাকে না। ফলে অন্য কোন মাধ্যম ব্যাতীতই যৌন মিলন করলেও স্ত্রীর গর্ভধারন করার সম্ভাবনা থাকে না।  এটা খুবই ছোট এবং সহজ একটা অপারেশন, এর জন্য হাসপাতাল বা ক্লিনিংকে ভর্তি হবার ও কোন প্রয়োজন হয় না।

মনে রাখতে হবে অপারশনের পরপরই এই পদ্ধতি কার্যকর হয় না, বরং প্রথম ৩০/৪০ বার যৌনমিলনে কন্ডম কিংবা অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে, এরপর আর অন্য কোনো পদ্ধতির সাহায্য নেবার প্রয়োজন হবে না। এটা জন্মনিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে ১০০% সুনিশ্চিত একটি পদ্ধতি। ভ্যাসেকটমি করার পরও কোন কারন বসত সন্তান নেবার ইচ্ছা হলে আবারও অপারেশন করে কেটে দেয়া ভাস দুটিকে জোড়া লাগিয়ে দেয়া সম্ভব এবং সন্তান ধারন করা সম্ভব হয়।  যদিও এর সফলতার হার কমে যায়।

ভ্যাসেকটমি করার পুর্বে অবশ্যই দম্পতির অন্তত দুটি সুস্থ সন্তান থাকতে হবে এবং এতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই যৌথ-সম্মতি থাকতে হবে। কিছু কিছু পুরুষ ভ্যাসেকটমি করার পর মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পরতে পারে এবং তার যৌনইচ্ছাও কিছুটা কমে যেতে পারে। চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে তা নিরাময় করা সম্ভব। ক্ষেত্র বিশেষ অন্ডকোষে স্পার্ম গ্রানুলোমা (Sperm granuloma)  নামক একটি সমস্যা হতে দেখা যায় যদিও এটা তেমন জটিল কোনো ধরনের সমস্যা নয়। ভ্যাসেকটমি স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রনের খুবই কার্যকর এবং সাশ্রয়ী একটি পদ্ধতি। ভ্যাসেকটমি সম্পর্কে জন সচেতনতা বাড়িয়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে একটি বিশাল উপাদান হিসেবে ব্যবহার করার অবারিত সুযোগ রয়েছে।

 

টিউবেকটমি বা টিউবাল লাইগেশন

টিউবাল লাইগেশন হচ্ছে মহিলাদের স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রনের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে মহিলাদের ডিম্বানুর গমন পথকে কেটে আলাদা করে দেয়া হয়। মহিলাদের  ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বানু ফেলোপিয়ান টিউব (Fallopian tube)  হয়ে জরায়ুতে আসে, টিউবেকটমি কিংবা টিউবাল লাইগেশন (Tubal ligation) অপারেশনের মাধ্যমে এই টিউব কে বেধে কিংবা কেটে দিয়ে এই পথ কে বাধাগ্রস্ত করা হয়।

যে সকল দম্পতির অন্তত দুইটি সম্পুর্ন সুস্থ সন্তান আছে এবং যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই যৌথ-সম্মতি থাকে তখনই কেবল টিউবাল লাইগেশন অপারেশন টি করা হয়। সাধারনত বাচ্চা ডেলিভারি হওয়ার পরই অথবা সিজারিয়ান সেকশন করে বাচ্চা ভুমিষ্ট করার সময় এই অপারেশন করা হয়ে থাকে। তবে চাইলে এটি যেকোনো সময়ই করা সম্ভব।

তলপেটের মাঝামাঝি ইঞ্চি খানেক লম্বা অংশের চামড়া কেটে এই অপারেশন করা হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে ফেলোপিয়ান টিউবটি বের করে তা কেটে এর দুই প্রান্ত বেধে দেয়া হয়। যে কোনো প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত চিকিৎসকই এটি করতে পারে। পরবর্তীতে কোন কারনে যদি কোনো দম্পতি মনে করে তাদের আরেকটি সন্তান নেবার প্রয়োজন আছে তাহলে মাইক্রোসার্জারি করে কাটা টিউবের দুই প্রান্ত আবার জোড়া লাগিয়ে দেয়া সম্ভব। এই দ্বিতীয় অপারেশনটি সাধারনত অতটা ফলপ্রসু হয়না, শুধুমাত্র এক তৃতীয়াংশ দম্পতির এই অপারেশনের পর পুনরায় সন্তান ধারন করার সম্ভাবনা থাকে।